সব লেখার নাম থাকে না


রাতে বাড়ি ফিরে দেখি, উঠোনে আলো জ্বলছে। আর তিনি বকুল গাছের নীচে। বেশ জাঁকিয়ে, দোকান পত্তর সাজিয়ে বসেছেন। তিনি মানে উনি। মাঝে মাঝে ধূমকেতুর মতো, আমার অরবিটে চলে আসেন। তখন দেখা হয়, কথা হয়, বাজনা শোনা হয়। আমায় দেখে আহ্লাদে গড়িয়ে যায় আর কী! এত রাত করে ফিরলেন, রাজামশাই? মুখখান শুকিয়ে গেছে। খেয়েছেন? ওর মুখে রাজামশাই শুনলে আগে গা জ্বলে যেত। আমার ডাকনাম ধরে ডাকে, আবার যেন কিছুটা ব্যঙ্গ করে। এখন সয়ে গেছে। বললাম, আপনি কিছু খেয়েছেন?   

দুপুরে মুড়ি খেয়েছি। এখন আর খাব না। আবার খাব কাল সকালে।  

বাড়িতে খাদ্য সংকট। খেতে চাইলে মুশকিলে পড়তাম। মাঝরাতে দোকানদারকে ডাকাডাকি করে তুলতে হত। তারপর ভাত করতে হত। আর কী কী করতে হতো কে জানে! যাইহোক বেঁচেছি। ব্যাগে বিস্কুট ছিল। ওর পাশে রেখে দিয়ে ভিতরে চলে গেলাম। সারাদিন গরমে ঝালাপালা হয়ে গিয়েছি। একটু স্নান করা  দরকার। স্নান করতে করতে শুনছি, দোতারা বাজছে। উঠোনে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনছি। বাজছে। মাথা ধরে আছে।  তার ওপর দোতারার টুং টাং। যেন আমার ঘিলুর তার একটা একটা করে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। এ এক অসহ্য উৎপাত। ভাবলাম, ধমকে চুপ করিয়ে দিই। এসব আমার দরকার নেই। সামনের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমাকেও ঘুমতে দিন। কিন্তু ওস্তাদ মানুষজনকে দাবড়ানি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়ার অওকাত আমার নেই। আর রোজ রোজ তো এমন ঘটনা ঘটে না। চাঁদ উঠেছে। কদম তলায় হাতি না নাচুক, বকুল গাছের নীচে দোতারা বাজছে। এই সময় হঠাৎ যেন কি একটা পায়। প্রেমই বোধহয়। লোকটার সঙ্গে লটাপটি করতে ইচ্ছে করে। না ঠিক লোকটার সঙ্গে নয়। ওর দুটো হাতের সঙ্গে। নাকি বাজনার সঙ্গে। নাকি এই রাতটার সঙ্গে। মনে হয়, আমি শাহাজাহান। আমি আরন্যদেব। আমিই ব্রহ্ম। ডানহাত দিয়ে সুরে সুরে আমার নিজের ভাগ্য লিখছি। বা হাত দিয়ে বেখেয়ালে সব মুছে ফেলছি। এক রাত হারছি। এক রাত জিতছি। হিসেব রাখা হচ্ছে না।

ঘুম ভাঙল, ঝাঁটার আওয়াজে। প্রবল আক্রোশে পানমনি, উঠোন ঝাঁটাচ্ছে।  

বাইরে এসে দেখলাম, সে নেই। বিদায় করে দিল নাকি! পানমনি রাগে গজগজ করছে। কাল রাতে ওই বুড়োটা এসেছিল তাই না! সদর দরজা খুলে রেখে পালিয়েছে। কেমন নোংরা করেছে দেখো। সত্যি। নোংরা সাফি, বিড়ির পাতা, প্রচুর দেশলাই কাঠি, ছাই, ভাঙা কল্কে আর এক পিস গামছা। যখনই আসে কিছু না কিছু ফেলে যায়। আগে বুঝতাম না। এখন বুঝি। এসব কোনও একদিন ফেরার বাহানা। কোনও একদিন আবার দেখা দেবে, সেই প্রতিশ্রুতি।


তবে এই লেখাটা যখন লিখছি, তখনও জানি না ফেরার ইচ্ছে আর সত্যিকারের ফেরা এক জিনিস নয়। আমার এক বন্ধু কাল সন্ধ্যায় চলে গেছে। কলকাতায় ফিরে রোববার দেখা হওয়ার কথা ছিল যে! আর কোনদিন দেখাই হবে না? ব্যাপার কী! গেলে কোথায়? তোমার নম্বরটা ডিলিট করে দেবো ফোন থেকে? তোমার এখন অন্য নম্বর হয়েছে। তুমিই না হয় একবার সেই অজানা নম্বর থেকে ফোন কোরো প্লিজ। ছিটকুল থেকে পশ্চিমের পাহাড় ডিঙিয়ে যে গ্রাম, কী যেন নাম বলেছিলে? বলেছিলে একটা রুট ম্যাপ বানাতে। সে তো আর বানানো হয়নি। তোমার বন্ধু হরি সিং আমায় নিতে আসবে তো? আমি গুপ্ত রাজ মন্দিরের বন্ধ দরজার সামনে অপেক্ষা করে থাকব।  

Comments