বিসর্জন


ফোন ছাড়া থাকো, আসুবিধা হয় না? যারা আমায় অল্প অল্প চেনেন, তারা গোল গোল চোখ পাকিয়ে এই সব প্রশ্ন এখনও করেন। তাঁদের প্রশ্নে, অবিশ্বাস, আদিখ্যেতা আর অবাক অবাক ভাব দেখে, এখন আর বিরক্ত হই না। কথাও বাড়াই না। ছোট্ট করে ‘না’ বলে চুপ করে যাই।   

ফোন ছাড়া থাকি, তেমন নয়। একটা বেসিক ফোন আমার নিশ্চয়ই আছে। সেই প্রথম থেকে যে নম্বর সেটাই। দরকার মতো দিব্যি কথা বলি। বাকি কাজ আমি আমার ডেস্কটপে করি। মাসের অর্ধেক সময় কলকাতায় থাকি না। তখন আমি অন্য কাজ করি। যে কাজ কম্পিউটারে করা যায় না, তেমন কাজ। যেমন ছবি আঁকি, যেমন পড়ি। যেমন ভাবি। ভাবনা টুকে রাখি। খাতায় কাটাকুটি খেলি। লোকজনের সঙ্গে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করি, চাষের গল্প। ভূতের গল্প বিশ্বাস- অবিশ্বাসের গল্প। বাগান করি। সেই বাগানটাকে ঘিরে যে ইকো সিস্টেম তৈরি হয়েছে, সেটা মন দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। অল্প বিস্তর শরীরচর্চা করি। মাস্ বাগানোর সাধনা নয়। একটু ব্যালান্সড আর ফিট থাকার জন্য। আমি তো মন দিয়ে কক্ষনও কিছু শিখিনি। সবই এক মাস দু মাস। শুধু শাওলিন কুং ফু শিখেছিলাম, আড়াই তিন বছর। সেটাই করি। সঙ্গে চার পাঁচটা যোগাসন। এর পরেও অনেক সময় যদি ফাঁকা লাগে, হাতে টর্চ নিয়ে টুকটুক করে চলে যাই, শুঁড়িখানায়। মাটির দাওয়ায় যত্ন করে তালাই পেতে দেয়। গ্যাঁট হয়ে বসে আকণ্ঠ হাঁড়িয়া খাই। নানা ধরনের কথা হয়। যে কথা আমি কলকাতা শহরে শুনি না, তেমন কথা। টিমটিমে হলুদ আলোটা ঝাপসা হয়ে গেলে তারপর উঠি। আর একটা জিনিস করি, সেটা জোর করে শুরু করেছিলাম। এখন সেটাই দস্তুর হয়ে গেছে। দরজায় তালা দেওয়ার মতো একটা খারাপ অভ্যাস আমার গেছে। দরজায় শেকলটা টেনে দিয়ে ঘুরে বেড়াই। গ্রামে যাঁদের একটু জমি জায়গা বা সরকারি চাকরি বা ব্যাবসা বা মোটর সাইকেল আছে--  তারা বলে দরজায় তালা দেবেন। চুরি হবে। গ্রামে দু তিনটে চোর আছে কিন্তু। আমি চোরদের বলেছি, বাড়িতে চুরি হলে, শালা তোদের এখানে থাকব না। বেচে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাব।    

জীবনের বহু সময় ধরে শহুরে জীবনে যা দেখেছি, যা পেয়েছি, যা নিয়ে ভুগেছি সব কিছু ধরে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি, বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তবে প্রতি বছর মা দুর্গাকে একটা কথাই বলি। সম্পূর্ণ অপাত্রে তুমি অনেক কিছু দিয়েছ। বরং এবার তুমি কিছু নিয়ে যাও তোমার পুঁটলি বেঁধেছেঁদে। আমার যত আজগুবি শহুরে সংস্কার, পাওয়া না পাওয়ার বোধ, বিচ্ছিরি লোভ—সব সঙ্গে নিয়ে যাও। এসব আমার আর চাই না।

Comments